ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার এবং আধুনিক বাংলা ভাষা

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার এর অন্তর্গত ভাষা ও উপভাষাসমূহ বিশ্বের ৬টি মহাদেশে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিবর্তন হয়। হিন্দি,বাংলা, ইংরেজি, লাতিন, ফার্সি ও রুশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক অনেক ভাষা এই পরিবারের অন্তর্গত।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার এর শাখাসমূহ

  1. আর্মেনীয় ভাষাপরিবার – বর্তমানে শুধু একটি সদস্য রয়েছে। যথা – আর্মেনীয় ভাষা
  2. আলবেনীয় ভাষাপরিবার – বর্তমানে শুধু একটি সদস্য রয়েছে। যথা – আলবেনীয় ভাষা
  3. ইতালিক ভাষাপরিবার – দক্ষিণ ইউরোপ ও দক্ষিণ আমেরিকায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা
  4. ইন্দো-ইরানীয় ভাষাপরিবার – ইরান, শ্রীলংকা, ও উত্তর ভারত উপমহাদেশে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা
  5. কেল্টীয় ভাষাপরিবার – পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি এলাকায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা
  6. গ্রিক ভাষাপরিবার – বর্তমানে শুধু একটি সদস্য (গ্রিক) রয়েছে
  7. জার্মানীয় ভাষাপরিবার – উত্তর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ও অশেনিয়ায় অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা
  8. বাল্টীয় ভাষাপরিবার – উত্তর-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা
  9. স্লাভীয় ভাষাপরিবার – রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত ভাষা ও উপভাষা

এক নজরে সংস্কৃত ভাষা পরিবার, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা

সংস্কৃত না পালি—ভারতের সবচেয়ে পুরোনো ভাষা কোনটি তা নিয়ে সুদীর্ঘকাল ধরেই বিতর্ক চলেছে। তবে সে বিতর্ককে পাশ কাটিয়েও বলা যায়, সংস্কৃত গ্রিকের চেয়ে বেশি নিখুঁত, ল্যাটিনের চেয়ে বেশি গভীর, এবং এ দুটো ভাষার তুলনায় অনেক বেশি নিপুণতার সাথে সংস্কারকৃত, যদিও তাদের উভয়ের সাথেই সংস্কৃতের যথেষ্ট পরিমাণে সাদৃশ্য রয়েছে। ক্রিয়াপদের মূল এবং ব্যাকরণগত গঠনপ্রণালীর দিক থেকে এ তিনটি ভাষায় এত বেশি মিল যে, ভাষাগুলোর উৎপত্তি যে একই উৎসমূল থেকে হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। সেই অজ্ঞাত মূল সূত্রটি অবশ্য চিরতরে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার এর অন্তর্গত ভাষা ও উপভাষাসমূহ বিশ্বের ৬টি মহাদেশে পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ায় বিবর্তন হয়। হিন্দি,বাংলা, ইংরেজি, লাতিন, ফার্সি ও রুশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক অনেক ভাষা এই পরিবারের অন্তর্গত।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা হতে আধুনিক বাংলা পর্যন্ত ক্রমিক ধারা

ভাষা ও জাতি এক নয়। আমরা যখন বাংলা ভাষার প্রাচীন ইতিহাস আলোচনা করি, তখন আমাদের এই কথাটি স্পষ্ট মনে রাখা দরকার যে, আদিম ভাষা হতে ক্রমেই পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে আমাদের আধুনিক বাংলা ভাষা এসেছে। সেই আদিম ভাষাভাষী জাতি ও বর্তমান বাঙালি জাতি যে এক হবে, তার কোনো স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ নেই। বরং নৃতত্ত্ববিদদের কথা মানতে গেলে আমাদের বলতে হবে যে, জাতিগত পার্থক্য সত্ত্বেও এক মূলভাষা বহু যুগের বহু স্থানের বহু লোকের মুখে মুখে ধারাবাহিক পরিবর্তনের ফলে আমাদের বর্তমান বাংলায় এসেছে।

আজ হতে কমপক্ষে ৫০০০ বছর আগে এক জাতি ইউরোপের মধ্যভাগ হতে দক্ষিণ পূর্বাংশ ভূভাগে বাস করতো এবং তারা মোটামুটি একই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতো। এই ভাষাকে ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষা (Indo-European Parent Speech) ধরা হয়। এই মূল ভাষাগোষ্ঠীর দুইটি বিভাগ (Groups) ছিলো। পণ্ডিতেরা একটিকে কেন্তুম (Centum) এবং অপরটিকে শতম (Satam) বিভাগ নাম দিয়েছেন। ইউরোপের ইন্দো-ইউরোপীয় মূলভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে আলবানি এবং বাল্টোস্লাবোনিক ছাড়া অপর সবগুলো ভাষা কেন্তুম বিভাগ থেকে উৎপন্ন। এশিয়া মহাদেশেও কেন্তুম বিভাগের দুইটি শাখা এক সময়ে বিদ্যমান ছিলো। তার একটির নাম হিত্তী (Hitti) ভাষা। এটি এশিয়া মাইনরে প্রায় দেড় হাজার খ্রিষ্টপূর্বে প্রচলিত ছিল। অপরটি তুখারী (Tokharian)ভাষা। এটি মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত ছিল। প্রায় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতক পর্যন্ত এই ভাষা জীবিত ছিল। কেন্তুম বিভাগের সাথে আমাদের বাংলা ভাষার কোনো সাক্ষাৎ সম্বন্ধ নেই, কিন্তু শতম বিভাগ হতে যে আর্য শাখা উদ্ভূত হয় তার সাথেই বাংলার সাক্ষাৎ সম্পর্ক রয়েছে। আর্য শাখার স্বাবিভাগীয় শাখাগুলো এই, যথা : আলবানি, বাল্টোস্লাবোনিক, আরর্মানী। আর্য শাখার দুইটি প্রধান প্রশাখা স্বীকার করা হয় : একটি ইরানি এবং অপরটি ভারতি। ইরানি প্রশাখা হতে আবেস্তার ভাষা, প্রাচীন পারসী ভাষা, পহলবি বা মধ্য পারসী ভাষা, আধুনিক পারসী ভাষা, কুর্দিস্তানি, বলোচি, আফগানি বা পোশতু, ওসেটিক, পামিরি প্রভৃতি ভাষা উৎপন্ন হয়েছে।

ভারতীয় আর্য প্রশাখা হতে ক্রমে বিবর্তন ও পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে বাংলার বর্তমান রূপ আমরা পেয়েছি। এই দুই প্রশাখার মধ্যবর্তী একটি প্রশাখাকে দারদি (Dardic) আখ্যা দেয়া হয়েছে। এটি হতে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশের কাফিরি ভাষাগুলো উৎপন্ন হয়েছে। ভারতীয় আর্য ভাষাকে আমরা প্রধানত তিনটি স্তরে বিভক্ত করতে পারি-
১. আদিম স্তর : – প্রাচীন ভারতীয় আর্য এবং আদিম প্রাকৃত (১২০০-৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)।
২. মধ্য স্তর : – মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা। এর তিনটি উপস্তর রয়েছে। যথা-
(ক) ১ম উপস্তর : – অশোক অনুশাসন লিপি, সাঁচি ও বাহুরতের প্রস্তর লিপি, খারবেল লিপি প্রভৃতির ভাষা। পালি এর একটি সাহিত্যিক রূপ। সংস্কৃত এই যুগের ব্রাহ্মণ্য সমাজের সাহিত্যিক ভাষা ছিল। এটি আদিম ও মধ্য স্তরের অন্তর্বর্তী। ৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব হতে ১০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই উপস্তর। আমরা একে প্রাচীন প্রাকৃত বলতে পারি।
সন্ধি স্তর : – (Transitional stage)_ নাসিক গুহার লিপি। পল্লব লিপি, সাতবাহন লিপি প্রভৃতির ভাষা। ১০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
(খ) ২য় উপস্তর : – নাটকীয় প্রাকৃত ভাষা। ২০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। আমরা একে মধ্য প্রাকৃত বলতে পারি। পরে এটি সাধারণত সংস্কৃত নাটকে ও জৈন সাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
(গ) ৩য় উপস্তর : – অপভ্রংশ। ৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। নাটকীয় প্রাকৃত অপভ্রংশ বস্তুত সমকালীন। কিন্তু আদিতে অপভ্রংশ ব্রাহ্মণেতর অর্থাৎ বৌদ্ধ বা জৈন সমাজে ব্যবহৃত হতো। সম্ভবত সম্মতীয় মতের বৌদ্ধগণ সর্বপ্রথম অপভ্রংশ ব্যবহার করেন। পরে ব্রাহ্মণ্য সমাজেও অপভ্রংশ ব্যবহৃত হতে থাকে।
আধুনিক স্তর : – আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির (New Indo-Aryan) প্রাচীনতম রূপ ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত। বাংলা ভাষা প্রাচীন রূপ (Old Bengali) পরিবর্তন করে মধ্য বাংলায় (Middle Bengali) পরিণত হয়। এই মধ্য বাংলা হতে আধুনিক বাংলার (Modern Bengali) উৎপত্তি হয়েছে। প্রাচীন বাংলা ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সন্ধিযুগ ১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। মধ্যযুগ ১৩৫০- ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। নব্য যুগ ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত। নব্যযুগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। ১৮০০ হতে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পুরাতন কাল এবং ১৮৬০ থেকে এখন পর্যন্ত বর্তমান কাল।

ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা হতে আধুনিক বাংলা পর্যন্ত স্তরগুলির কালক্রম

  1. ইন্দো-ইউরোপীয়ান, আনুমানিক ২৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
  2. ইন্দো-ইরানি, আনুমানিক ১৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
  3. প্রাচীন ভারতীয় আর্য (বৈদিক উপভাষাগুলো), আনুমানিক ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
  4. মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচ্য শাখার বিবর্তন, আনুমানিক ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
  5. মগধের মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার আদি স্তর (প্রাচীন মাগধী), আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
  6. মগধের পরিবর্তনশীল মধ্যভারতীয় আর্য ভাষা, খ্রিষ্টাব্দের প্রায় সমকালীন।
  7. মগধের মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার দ্বিতীয় স্তর, আনুমানিক ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  8. মগধ এবং বাংলার অর্বাচীন মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা বা মাগধ অপভ্রংশও, আনুমানিক ৮০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  9. প্রাচীন বাংলা, আনুমানিক ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  10. আদি মধ্য বাংলা, আনুমানিক ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  11. অর্বাচীন মধ্য বাংলা, আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ।
  12. নব্য বাংলা বা আধুনিক বাংলা ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের পর।

তিনি তাঁর পরবর্তী Indo-Aryan and Hindi পুস্তকে মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সময় ৩৫০০- ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ অনুমান করেছেন। তবে তাঁর এই সমস্ত কাল নির্ণয় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বীকার করেন নি।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা সোর্স:


আপনার মতামত প্রকাশ করুন

আপনার ই-মেইল গোপন থাকবে। চিহ্নিত স্থান পূরণ করা আবশ্যক